কেমন আছ,সেঁজুতি? বড় জানতে ইচ্ছে করে। তোমারও কি ইচ্ছে করে, আমি কেমন আছি জানতে? না, তোমার ইচ্ছে হওয়ার কথা না। উদাস মনে কি এসব প্রশ্ন উঁকি দেয়? আচ্ছা, সেঁজুতি, তুমি এত উদাসিনী কেন? উদাস হয়ে তুমি এত কী ভাব? নিজের কথা? নাকি কোন প্রিয়জনের কথা?
কে সে, তোমার প্রিয়জন? সেও কি ভাবে, তোমাকে নিয়ে, উদাস হয়ে? সেও কি আমার মত উন্মুখ হয়ে থাকে, তোমার হৃদয় উজাড় করা ঝলমলে হাসিটি দেখতে? সে কত ভালবাসা তোমাকে দেয়? সে কি ঘুমের ঘোরে তোমার সাথে কথোপকথন করে? অথবা, ঘুম থেকে উঠেই কি বলে- ‘ইশ! স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেল? সেঁজুতিও বাতাসে মিলে গেল। ধুর! এসব ঘুমের কোন মানে আছে?’ তার বিষণ্ণ মনটা আবার তোমার কথা ভেবেই প্রফুল্ল হয়ে উঠবে। তোমার সাথে দেখা হলেই প্রাণের উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়বে, কথার ফুলঝুরি ফুটাবে। তুমি তার অপেক্ষায় থাকবে, পার্কের কোন এক কোণায় অথবা লাইব্রেরীর বারান্দায়। সে চুপি চুপি পেছন থেকে এসে তোমার চোখ দুটো চেপে ধরবে। তুমি জ্যোতিষীর ভাব নিয়ে তার নাম বলবে। সে অবাক হয়ে বলবে, কী করে জানলে? তুমি একটু মুচকি হেসে আবার উদাস হয়ে বসে থাকবে। তর্জনীর ইশারায় চশমাটা খানিক উপরে তুলে দিয়ে তাকিয়ে থাকবে আকাশের পানে। উদাসীনতার ছলে অনুভব করার চেষ্টা করবে সে তোমাকে কত ভালবাসে! অথবা, সে যখন আসবে, তুমি মুখ গোমড়া করে ওদিকে তাকিয়ে থাকবে। সে দিব্যি খেয়ে দেরীতে আসার নানা অজুহাত দাঁড় করাবে। অথবা, এসেই রহস্যের হাসি হেসে সে বলবে, বলতো, আমি তোমার জন্য কী এনেছি? তুমি অবাক হয়ে কপালটা ভাজ করে জিজ্ঞেস করবে, কী এনেছ? সে বলবে হাতটা দাও। তুমি হাত বাড়াবে। এই নাও বলে উপহারটা তোমার হাতে তুলে দিবে। ‘ওয়াও! এত সুন্দর!’ -বলে তুমি উচ্ছ¡সিত হবে। সে কম্পিত হস্তে তোমার দুই বাহুতে হাত রাখবে। তুমিও তার বুকে আশ্রয় নিয়ে তাকে আনন্দে উদ্বেলিত করবে। দুজন পাশাপাশি হাঁটবে, হাতে হাত ধরে অথবা তার বাহুডোরে। হাটতে হাটতে ক্লান্ত হলে, কোন ঝোপের আড়াল খুঁজবে। জীবনের ছোট-বড় আনন্দ-বেদনার কথা বলতে বলতে দুজন আরও ঘন হয়ে বসবে। অথবা তুমি তার কোলে মাথাটা রেখে পরম সুখে বিভোর হবে। সন্ধ্যার মৃদু অন্ধকারে চুমোয় চুমোয় উথলে উঠবে তোমাদের যৌবন। ক্লান্ত হলে, আজ আর পারছি না- বলে, দুজন দুজনকে ছাড়বে। বাসায় ফিরতে ফিরতে তুমি তার কথা ভাববে, সে ভাববে তোমার কথা । বিছানায় চিৎ হয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারের স্মৃতি পুনর্জাগরিত করবে। পরম সুখের কথা ভেবে তুমি আনন্দে ভাসবে। তোমার ক্লান্ত দেহের ধকল সইতে না পেরে চোখ জুড়ে আসবে ঘুম। ঘুমের রাজ্যেও তোমার আর তোমার প্রেমিকের আধিপত্য। সেখানে তোমরা হাসি আনন্দে খেলে বেড়াবে। দুজন দুজনকে আনন্দে ভরিয়ে রাখবে সারাক্ষণ। চোখের আড়াল হলেই, বন্ধ করবে দু’চোখ। তাকেই পাবে। সেও তোমাকে পাবে।
কিন্তু, আমি? আমি কী পাব? তুমি হয়তো ভাবছো, আমার কী পাওয়ার অধিকার আছে? হ্যাঁ, আমার কোন অধিকার নেই। কিন্তু, অধিকারে আমার কী আসে যায়? অধিকার ছাড়া কি কিছু আশা করতে নেই? এ জগতে যার যা অধিকার, সবাই কি তা পায়? এমন কি কেউ নেই যে, গেল অধিকার আদায়ে-এল নি:স্ব হয়ে?
অধিকারের কথা থাক। ওসবে আমার কাজ নেই। আমি শুধু তোমার ঐ নির্মল হাসিটুকুর একটু ছটা পেলেই হয়। আমি শুধু দেখব। মন ভরে দেখব। দেখব, তোমার হাসির সময় ঠোঁটের দুপাশের গালের সম্প্রসারণ। আমি ছুঁব না, ছুঁব না তোমার গাল। শুধু দেখব তোমার হাসিটুকু। তুমি যখনও জোরে হাসবে কিংবা কথা বলবে তোমার গালের টোল পড়া দেখব। তুমি অবাক হলে, তোমার কুঞ্চিত ভ্রু দেখব। আমি শুধু দেখব ওসব, ছুঁব না কিছুতেই। ছুঁয়াছুঁয়ি তোমার প্রেমিকই করবে।
আমার দেখাদেখির কথা শুনে গাবড়ে যেয়ো না। তোমার হাসি, গালের টোল, কুঞ্চিত ভ্রু এসব ছাড়া অন্যকিছুতে নজর দেব না। তোমার আঁটোসাঁটো জামা ভেদ করে ফুলে উঠা স্তনের দিকেও না। ছিপা প্যান্ট পরে যখন হাঁটবে, পেছন থেকে তাকিয়ে দেখব না কোন মাংসপিণ্ডের তুফান। কোন ভিড়ে দুজন পাশাপাশি থাকলে, ‘ইশ এত ভিড়’ বলে তোমার শরীরে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করব না। পথের মাঝে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময়, ‘এদিকে সরে এসো’ বলে, তোমার নরম তুলতুলে শরীর ছুঁব না। ছুঁয়াছুঁয়িতে আমি নেই। এসব কোন অসভ্য কিংবা উদগ্রীব প্রেমিকের কাজ। আমি এই সভ্য সমাজেরই বাসিন্দা। কিন্তু তথাকথিত প্রেমিক নই।
আমি তথাকথিত প্রেমিক নই বলেই প্রেমের অভিনয় জানি না। শুধু তোমাকে ভালবাসি বলেই কাউকে নিবিড়ভাবে চাই না। চাই না কাউকে একান্তে নির্জনে। সকাল-সন্ধ্যা আর কারো আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনি না। ভাবনার অতলে অন্য কারো অস্তিত্বের চিহ্ন বয়ে বেড়াই না। তাই বলে ভেব না, আমি কাম-ক্রোধহীন! তোমার সে নির্মল হাসি, সুডৌল দেহ, আঁটসাঁট জামার তলে ফুলে উঠা দুটি স্তন আমাকে টেনেছিল একদা। ওগুলো আমায় নেশা জাগিয়ে দিয়েছিল। ঘোরের মধ্যে ছিলাম কিছুদিন। কিন্তু, তোমাতে আমাতে যে অদৃশ্য বাঁধার প্রাচীর, তা টপকানোর সাহস কিংবা শক্তি আমার নেই। আমি সভ্য সমাজের বাসিন্দা। আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম আমাদের সভ্যতা শিখিয়েছে, মানবতা শেখায় নি। তাই, তোমাতে আমাতে যোজন যোজন দূরত্ব। এত যখন দূরত্ব, কী করে আমরা একে অপরে মিশে যাই?
আচ্ছা, যদি এই দূরত্বটা না থাকতো? তুমি কি আমার হতে, যখন তোমাকে চাইতাম আপন করে। নি:স্ব আমি তোমাকে হয়তো দিতে পারতাম না প্রেমিক হিসেবে কাড়ি কাড়ি টাকা কিংবা দামি উপহার। কিন্তু, তোমাকে আদরে আদরে ভরিয়ে রাখতাম নিজের মত করে। তোমার বান্ধবীদের সাথে যখন আড্ডা দিতে, আমি একপাশ থেকে অপেক্ষা করতাম কখন তুমি হাসবে। মুখখানা কোন কিছুর আড়ালে পড়ে গেলে, অন্যপাশে সরে যেতাম, যেখান থেকে ভাল দেখা যায়। এভাবে আমি ঘুরতাম এপাশ থেকে ওপাশ। কেউ কেউ দেখে বদমাশ ভেবে দেখে নিত এক হাত। কেউ বা দু’চারটা কথা শুনিয়ে যেতো। তোমার বান্ধবীদের কেউ কেউ গলা খাঁকরি দিত। অথবা তোমাকে ক্ষেপাতো। তুমি বলতে, পাগল কোথাকার। শপিং-এ গেলে তুমি থাকতে পাশে। ছবি দেখতে গেলেও তুমি পাশে। কোন উৎসবের দিন ডিসি হিলে, ফয়’স লেকে, জাতি সংঘ পার্কে, স্বাধীনতা পার্কে কিংবা অন্য কোথাও পাশাপাশি হাঁটতাম দু’জন। বাদামের খোসা ছড়াতে কথা হত দু’জনের। অনেক কথা-ই হত আমাদের। সুখ-দুঃখ, আশা- নিরাশা, পাওয়া- না পাওয়া, দেখা- অদেখা, পছন্দ- অপছন্দের কথা। কখনো কখনো ছোট-খাটো ঝগড়াও হতে পারে। তুমি বলতে এক কথা, আমি বলতাম অন্যটা। শুনে তুমি রেগে যেতে। অভিমানে কথা বলা বন্ধ রাখতে। আমি চেষ্টা করতাম তোমার অভিমান ভাঙ্গার। নানা কায়দায় তোমার গুমরা মুখে হাসি ফুটাতে না পারলে নিজেই হয়ে যেতাম গুমড়া মুখো। হঠাৎ তুমি এসে বলতে, ভুলে যাও ওসব। আমি আনন্দে উদ্বেলিত হতাম। আর অবাক হয়ে ভাবতাম, মেয়েদের এত রূপ! এই প্রেমিকা, এই অভিমানী, এই রাগী, এই ভুলে যাওয়া, এই মনে পড়া!
সেঁজুতি, তোমার কয়টা রূপ? হয়ত তুমি নিজেও জানো না। হয়ত বা কেউই জানে না। তোমার সৃষ্টিকর্তা জানলে জানতে পারে। আচ্ছা, তোমার সৃষ্টিকর্তাও কি তোমার হাসিতে মুগ্ধ হয়? তোমার মুখে অপরূপ হাসি সৃষ্টি করে তিনিও কি অবাক হন নি? তিনি কি তোমার মুখে, চোখে, ঠোঁটে, কণ্ঠে, স্তনে, মাংসপিণ্ডের পরতে পরতে রূপের পসরা সাজিয়ে মায়া আর উন্মাদনা সৃষ্টি করে দর্শকদের মন পরীক্ষা করেন? এতেই বুঝি তার সুখ! থাক, ওসব। সৃষ্টিকর্তার বিষয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে মন সায় দেয় না। মন আমার উড়ো উড়ো শুধু একটি হাসির খোঁজে। শুধু একটি হাসি দেখতে এখনো উন্মুখ হয়ে আছি। যে হাসি ঢেউ তুলে আমার প্রেম সাগরে। মানুষের আয়ু যদি অফুরান হয়, তবে আমার ভালবাসার আয়ু অনন্তকাল।